রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রংপুরেই চির নিদ্রায় শায়িত হলেন এরশাদ – সংগৃহীত
রংপুর সিটি মেয়র ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নেতৃত্বে লাখো মানুষের নজীরবিহীন বিক্ষোভের মুখে অবশেষে ওছিয়তকৃত পল্লী নিবাসের লিচুবাগানেই সমাহিত হলেন পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রওশন এরশাদ, জিএম কাদেরসহ পার্টির নীতি নির্ধারকদের ঢাকায় বনানী কবরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। বিকেল ৫ টা ৪৩ মিনিটে সেনাবাহিনীর তত্বাবধায়নে রাষ্ট্রীয় ও সামরিক মর্যাদায় লাখো জনতা তাকে সমাহিত করেন।
মঙ্গলবার ফজরের আজানের পর কিছুটা আবহাওয়া খারাপ হলেও রংপুর মহানগরীতে এরশাদের জানাযা ও দাফন কার্যে অংশ নিতে উত্তরাঞ্চলের ষোল জেলা থেকে নেতাকর্মী এবং রংপুর অঞ্চল থেকে আসতে শুরু করেন মানুষ। সকাল ৯ টায় আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে নারী পুরুষ থেকে আবাল বৃদ্ধবনিতার ঢল নামে রংপুর কেন্দ্রীয় কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে। যে মাঠে এরশাদ গত কোরবানীর ঈদেও নামাজ পরে সবার সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। দুপুর ১২ টা ১৪ মিনিটে রাজধানীর পশ্চিম পান্থপথের আলিফ মেডিক্যাল সার্ভিসের একটি লাশবাহী ফ্রিজ গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো-শ-১১-২৫৯৪) করে রংপুর সেনানিবাস থেকে এরশাদের মরদেহ আনা হয় কালেক্টরেট মাঠে। গাড়িটি চালিয়ে আনেন আব্দুর রহিম নামের এক চালক। এরপর তার মরদেহকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেয়া হয়, পালন করা হয় নিরবতা।
পরে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সিটি মেয়র, ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসকম পুলিশ সুপার ছাড়াও জাতীয় পার্টি, আওয়ামীলীগ, বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক, রাজনীতিক, পেশাজীবি, প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ।
অন্যদিকে ইতেমধ্যেই কালেক্টরেট মাঠ ভর্তি হয়ে মানুষের ঢল চলে যায় আশেপাশের রাস্তায়, প্রধান সড়কে।এরই মধ্যে লাশের গাড়ির আশপাশসহ পুরো মাঠ ও নগরীর আনাচে কানাচে চলতে তাকে, এরশাদের সমাধি রংপুরে দিতে হবে, রংপুরের মাটিতে দিতে হবে সমাধি সহ বিভিন্ন শ্লোগান। শ্লোগানের মধ্যেই মাইকে বক্তব্য দিতে থাকেন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতারা। বিক্ষোভ আরো বেড়ে গেলে বেলা ২ টায় হাতে মাইক নিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য, রংপুর মহানগর সভাপতি ও সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ঘোষণা দেন, স্যারের মরদেহ আমাদের কাছে আছে। কেউ মরদেহ নিয়ে যেতে পারবে না। রক্তের বিনিময়ে হলেও পল্লী নিবাসেই স্যারের সমাধি আমরা করবো।
এরপর শুরু হয় জানাযা নামাজের প্রস্তুতি। জানাযার প্রস্তুতির মধ্যে বক্তব্য রাখেন এরশাদ পুত্র সাদ এরশাদ, মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, চেয়ারম্যান জিএম কাদের। জিএম কাদের বক্তব্য দেয়ার সময় এরশাদকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকায় সমাহিত করার ইঙ্গিত দিলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এ সময় লাখো জনতা সেখানে বিক্ষোভ করতে থাকে এবং রংপুরে সমাধি চাই দাবী তোলে। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চলে চরম উত্তেজনা। মঞ্চের মধ্যে উত্তেজনা বেশি ছড়িয়ে পড়লে এক পর্যায়ে মেয়র মোস্তফা জিএম কাদেরের হাত থেকে মাইক নিয়ে ঘোষনা দেন, স্যারের সমাধি পল্লী নিবাসেই হবে। জানাজার প্রস্তুতি নিন। এরপর ২ টা ২৭ মিনিটে শুরু হয় জানাজা।
ইমামতি করেন রংপুর করিমিয়া নুরুল উলুম মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ইদ্রিস আলী। জানাযা নামাজ শেষে আবারও লাশের গাড়িকে ঘিরে বিক্ষোভ করতে থাকে। এক পর্যায়ে বেলা ২ টা ২৭ মিনিটে লাশের গাড়িতে উঠে পড়েন মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, মহানগর সেক্রেটারি এসএম ইয়াসির। এরইমধ্যে রোল পড়ে যায় লাশ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। বিক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে নিজেই ড্রাইভ করে গাড়ি চালিয়ে মাঠের পুর্ব দিক দিয়ে রওনা দেন মেয়র মোস্তফা। এসময় গাড়ির সামনে পেছনে হাজার হাজার মানুষের শ্লোগান চলতে থাকে। লাশের গাড়ি এগুতে থাকে অতি ধীরে। লাশ ডিসির মোড় হয়ে যাওয়ার কথা থাকায় চেকপোস্ট পর্যন্ত কড়া নিরাপত্বা বলয় তৈরি করে প্রশাসন। কিন্তু মোস্তফা নিজে গাড়ি চালিয়ে উল্টোপথ সিটি করপোরেশনের দিকে রওনা হন। লাশের গাড়ি যখন সিটি করপোরেশনের সামনে।
ঠিক তখনই জিএম কাদের সাংবাদিকদের জানান, আমিও চেয়েছিলাম রংপুরের হোক ভাইয়ের সমাধি। কিন্তু ভাবীসহ অন্যান্যরা ঢাকায় হওয়ার পক্ষে ছিল। রংপুরের মানুষের ভালোবাসার বিষয়টি আমি সাথে সাথে ভাবী রওশন এরশাদকে জানাই। তিনিও রংপুরে দাফনের অনুমতি দেন এবং কবরের পাশে তার জায়গা রাখার কথা বলেন। মুহুর্তেই তা ব্রেকিং নিউজের চাংকে স্থান পায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেটি বিশ্বাস করছিলেন না। সেকারণে এরশাদের মরদেহ বহনকারী লাশটির সামনে পিছনে বিক্ষোভ চলতেই থাকে। সেকারণে ধীরেই এগুতে থাকে গাড়ি। পরে পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানী মোড়, শাপলা, খামার মোড় লালবাগ কলেজপাড়া দর্শনা হয়ে পল্লী নিবাসে গিয়ে লাশের গাড়ি পৌছায় বিকেলে ৪ টা ৪৭ মিনিট। ৫ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগে ২ ঘন্টারও বেশী। এরই মধ্যে জিএম কাদের, মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ জাতীয় পার্টির ঢাকা থেকে আসা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পল্লী নিবাসে গিয়ে উঠেন।
অন্যদিকে এরইমধ্যে এরশাদকে সমাহিত করতে খনন করে রাখা পল্লী নিবাসের লিচু বাগানের কবর ও আশেপাশের এলাকায় সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে সেনাবাহিনী ৫ টা ৪০ মিনিটে এরশাদের মরদেহকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। ৫ টা ৪৩ মিনিটে সেনাবাহিনীর তত্বাবধায়নে নিজের লাগানো লিচুবাগানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এরশাদ। লাখো জনতা দাফন কাফন কাজে অংশ নিয়ে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। গত ৮ জুলাই এরশাদকে রংপুরে সমাহিত করার দাবি প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েদিয়েছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
গত ২৬ জুন জ্ঞান হারিয়ে রাজধানীর সিএমইচএ ভর্তি ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রোববার পৌনে আটটায় সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার নেতাকর্মীসহ এ অঞ্চলের মানুষ।
Leave a Reply